আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে
চাকরির সুবাদে বাসা থেকে দূরে থাকতে হয়। সপ্তাহে একদিন বাসায় যাবার সুযোগ
মেলে। বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করে বাসায় যাই আবার শনিবার সকালে এসে অফিস করি।
সপ্তাহের যে কয়টা দিন বাসার বাইরে থাকি সে সময়টাতে মোবাইলে কথা হয় ছেলেটার
সাথে। বয়স পাঁচ বছর হলেও বেশ সুন্দর আর গুছিয়ে কথা বলতে পারে ও। ফোন করেই
সবার প্রথমে যে প্রশ্নটা করবে সেটা হলো বাবা কখন আসবা? শনিবার থেকে
বৃহস্পতিবার, পুরো সপ্তাহ জুড়েই ওর এই একই প্রশ্ন। ছানাটার মাও চাকরি করে।
ছানাটা আমার ঠিকমতো বাবা-মার সংস্পর্শ পায় না। সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে
বাবার জন্য। বাবার কাছে হাজারটা বায়না ওর। মাঝে মাঝে ধমকও দেয় ওর মা। আমি
নিষেধ করি কাছে থাকলে। ছানাটার মা ছানাটাকে বুঝায় এত বেশি আবধার করো বলে
বাবা আসে না। আর বেশি কিছু চাবা না। ছোট মানুষ, মা যা বুঝায় তাই বুঝে। অযথা
কান্নাকাটিও করেনা তেমন। আমাকে ফোন দিয়ে বলে বাবা বাবা আমি আ....র তোমার
কাছে কিছু চাইবো না। শুধু আমার জন্য চকলেট নিয়ে আইসো। মা বলেছে বেশি বেশি
আবধার করি বলে তুমি আমার সাথে থাকো না। চকলেট চাওয়া কি বেশি কিছু চাওয়া হবে
বাবা? তাহলে চকলেটও চাইনা। তুমি তাড়াতাড়ি আসো বাবা। আমি ওর কথা শুনে চোখের
পানি ধরে রাখতে পারি না। গলাটা বারবার আটকে আসে আমার। কন্ঠ দিয়ে স্বর বের
হয়না সহজে।
বাসায় ওর জন্য চকলেট নিয়েছিলাম সেদিন। আরো কিছু ছিলো।
কিন্তু চকলেট বা অন্য সব কিছুর প্রতি দেখলাম কেমন একটা অনাগ্রহ ভাব।
এমনিতেই আমার কাছ থেকে সরতে চায় না বাসায় গেলে, আজও তার ব্যতিক্রম হয় না। ও
আমার সাথে লেগে থাকে। আমিও আদর দেই ছেলেটাকে। অবসরটা সবটুুকুই ওকে দেবার
চেষ্টা করি।
আনন্দের সময়গুলো শেষ হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। পরিবারের সাথে
থাকলে কোনদিক দিয়ে যে শুক্রবার চলে য়ায় টের পাই না। আবারও যাবার সময় হয়ে
যায় আমার। শনিবার হলে যেন বাচ্চাটার ঘুম খুব তাড়াতাড়ি ভাঙে। কারণ যে আর
কিছুই না। বাবাকে বিদায় দিতে হবে। এ বিদায় ক্ষনিকের হলেও কষ্টের। ছেলে আমার
মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দরজায়। বাসা থেকে যতক্ষন আমাকে দেখা যায় ও
তাকিয়েই থাকে। সবশেষ যখন আমার রাস্তা পরিবর্তন করার সময় আসে আমিও ঘুরে
তাকাই ওর দিকে। হাত নেড়ে বিদায় নেই পুন:রায়। বাবাটার জন্য এক বুক শুন্যতা
নিয়ে কাজে ফিরি।
বাসা থেকে বের হবো এখনই। অফিসে যেতে লেট হয়ে যাচ্ছে
বলে একটু তাড়াতাড়ি করছি। পাঁচ বছরের ছেলেটা বের হওয়া দেখলে আর পিছু
ছাড়েনা। যেখানেই যাবো সাথে যেতে হবে ওর। বাথরুমে গেলেও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে
থাকে। ছেলেটা আমাকে খুবই ভালোবাসা বুঝি। আমারও মন খারাপ হয় ওকে রেখে দূরে
থাকতে। কিন্তু আজ যেন একটু বেশিই ঘুর ঘুর করছে পিছুপিছু। আমি লক্ষ্য করলাম ও
মাঝে মাঝে আমার পকেটেও হাত দেবার চেষ্টা করছে। যা কখনো করে না ও! কিন্তু
আমি ওসবে পাত্তা দিচ্ছি না। আমার মতো আমি তৈরি হচ্ছি। এক সময় ওর একটা হাত
আমার পেছন পকেটে ঢুকিয়েই দেই। আমি ব্যস্ততার মাঝে একটু বিরক্ত হই। ধমকের
স্বরে ওকে বকা দিয়ে ফেলি। ও আমার এই রূপ দেখে না খুব একটা। বকা খেয়ে ভয়
পেয়ে যায় ও। দূরে দাঁড়িয়ে থাকে আর আমার দিকে থাকে ওর করুন দৃষ্টি। কিন্তু
ধমক খেয়ে কান্না করে না। আমি লক্ষ্য করলাম যে হাতটা আমার পকেটে ঢুকিয়েছিলো
সেই হাত মুঠো করে আছে। আমি আবারো ধমকের স্বরে বললাম দেখি হাতে কি তোমার?
আমার
ধারনা ছিলো ও হয়তো আমার পকেট থেকে টাকা নেবার জন্য এমন করছে। কাছে গিয়ে ওর
হাতের মুঠি খুলে আমি অবাক হয়ে যাই। ওর ছোট মুঠিটার ভেতরে দেখি একটা চকলেট
নিয়ে রেখেছে। আমি এবার একটু শান্ত হই। শীতল কন্ঠে জিজ্ঞাসা করি হাতে চকলেট
কেন বাবা? ছেলেটা আমাকে বলে বাবা, তুমি তো অনেক দূরে যাচ্ছো। গাড়িতে যদি
গলা শুকায় তখন পানি খাবা কোথায়। তার জন্য এই চকলেট টা তোমার পকেটে দিতে
চেয়েছিলাম। ওর উত্তর শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ! নিজের পা দুটো
সরাতে পারছিলাম না। স্ট্যাচু মনে হচ্ছিল নিজেকে। কিছু সময়ের জন্য নিজেকে
সামলে নিলাম। ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমে খেলাম। এতটুকুন ছেলে, ওর এতো
বুদ্ধি আসলো কোথা থেকে! ছেলেটার মাও পাশে দাঁড়ানো তখন। আমি লক্ষ্য করলাম
গায়ের উড়নায় ছেলেটার মা চোখ মুছছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন